একটি দাম্পত্য জীবন টিকে থাকে পারস্পরিক বোঝাপড়া, সম্মান ও ধৈর্যের উপর। কিন্তু এই সম্পর্কের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায় যখন তৃতীয় কোনো ব্যক্তি ক্রমাগত হস্তক্ষেপ করতে থাকে। বিশেষ করে বাংলাদেশের পারিবারিক কাঠামোয় মেয়ের সংসারে মায়ের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ অনেক সময় সুখী দাম্পত্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। অনেক মা হয়তো স্নেহবশত মেয়ের জীবনে যুক্ত থাকতে চান, কিন্তু অজান্তেই তারা মেয়ের সংসার ভাঙনের পথ তৈরি করে ফেলেন।
১. ভালোবাসা থেকে শুরু, সমস্যা দিয়ে শেষ
বেশিরভাগ মা মনে করেন, মেয়ে কষ্ট পাচ্ছে এই ভাবনাতেই তারা মেয়ের সংসারে হস্তক্ষেপ করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার ছোটখাটো বিরোধে মা যুক্ত হলে তা দ্রুত বড় আকার নেয়। পারিবারিক পরামর্শক Dr. Shaheen Akhtar (Dhaka University) এর মতে, “৭০% দাম্পত্য কলহের পেছনে আত্মীয়দের, বিশেষ করে মেয়ের মায়ের অতিরিক্ত সম্পৃক্ততা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে দায়ী।”
২. স্বামীর আত্মসম্মান ও পুরুষত্ববোধে আঘাত
যখন স্ত্রী বারবার বলে “মা বলেছে এটা করো না” বা “মা বলেছেন তুমি ভুল”, তখন স্বামীর মধ্যে একধরনের হীনমন্যতা তৈরি হয়। পুরুষরা সাধারণত সংসারে নিজের নেতৃত্ব ও দায়িত্ববোধ বজায় রাখতে চায়। সেখানে শাশুড়ির নির্দেশে চলা স্বামীর কাছে অপমানজনক মনে হয়। এতে ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরি হয়, যা একসময় ডিভোর্সে রূপ নেয়।
৩. মেয়ের আত্মনির্ভরতার অভাব
অনেক সময় মেয়েরা নিজে সিদ্ধান্ত নিতে শেখে না, কারণ মা সবসময় পরামর্শ দেন বা নির্দেশ দেন। এর ফলে স্ত্রী নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারে না, সংসারে যুক্তি ও ভারসাম্য হারায়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ২০২3 সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “শ্বশুরবাড়িতে মানিয়ে নিতে না পারা ও পিতৃগৃহের অতিরিক্ত প্রভাব ৩২% বিবাহবিচ্ছেদের কারণ।”
৪. ‘আমার মেয়ে কষ্টে আছে’ মানসিকতা
অনেক মা ধরেই নেন, মেয়েকে সবসময় কষ্টে রাখা হয়। অথচ সংসারে মতভেদ মানেই কষ্ট নয়। দাম্পত্য সম্পর্কের প্রতিটি ঝগড়া বা মতবিরোধ যদি মায়ের কান পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তাহলে মায়ের মনেও ঘৃণা জন্মে, যা আবার মেয়ের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়। এভাবে দু’পক্ষের মধ্যে অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়।
৫. সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে
Bangladesh Institute of Social Research (BISR) এর ২০২4 সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে সংঘটিত ১০টি ডিভোর্সের মধ্যে ৪টিতে মেয়ের মায়ের অতিরিক্ত সম্পৃক্ততা বা প্রভাব ছিল একটি মূল কারণ। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারে যেখানে মা মেয়ের ওপর আবেগীয় নিয়ন্ত্রণ রাখেন, সেখানে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
৬. পরিণতি: দাম্পত্যে তৃতীয় পক্ষের অনুপ্রবেশ
যখন স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কথোপকথন বা সিদ্ধান্ত তৃতীয় কোনো ব্যক্তি, অর্থাৎ মা, দ্বারা প্রভাবিত হয়, তখন সম্পর্কের স্বচ্ছতা নষ্ট হয়। গোপনীয়তা ভেঙে যায়, আস্থা কমে যায়। আর এই আস্থাহীন সম্পর্ক বেশিদিন টিকে না।
৭. সমাধান কী হতে পারে?
# মাকে বুঝতে হবে, মেয়ের সংসার তার নয়।
# মেয়েকে ছোট থেকেই শেখাতে হবে—নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে।
#দাম্পত্যের সমস্যা নিয়ে প্রথমে স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হবে।
প্রয়োজনে থেরাপিস্ট বা কাউন্সেলরের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু আত্মীয়দের নয়।
মায়ের উচিত, মেয়ের জীবনে স্নেহের জায়গায় থাকা, নিয়ন্ত্রণের জায়গায় নয়।
ভালো মা সেই, যিনি মেয়ের সংসারে সুখ চান, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ চান না। ভালোবাসা মানে নির্দেশ দেওয়া নয়, বরং দূর থেকে প্রার্থনা করা যে মেয়ে যেন নিজের সংসার সুন্দরভাবে গড়ে তোলে। মায়ের অতি-হস্তক্ষেপ অনেক সময় ভালো উদ্দেশ্য নিয়েও অমঙ্গল বয়ে আনে। তাই প্রত্যেক মায়েরই উচিত, মেয়েকে মানসিকভাবে শক্ত হতে সাহায্য করা—সংসারে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে শেখানো। তাহলেই মেয়ের দাম্পত্য টিকে থাকবে, পরিবারে শান্তি ফিরবে, এবং সমাজে ডিভোর্সের হার কমবে।